Tuesday, March 6, 2018

REFRIGERATOR

ফ্রেশ খেতে কে না চায়। আর এই চাওয়া থেকেই ফ্রিজ এখন মানুষের নিত্যসঙ্গী। খাবার শীতল করার এই ইলেকট্রনিক ডিভাইসটিকে সাধারণভাবে সবাই ফ্রিজ বলে জানলেও কেতাবি নাম রেফ্রিজারেটর। মূল কাজ খাবার, পানীয় ও জীবন রক্ষাকারী বিভিন্ন ওষুধ দীর্ঘদিন শীতল ও ভালো রাখা।
রেফ্রিজারেটরের আবির্ভাব ঘটেছে অনেক গবেষণা ও উন্নয়নের মাধ্যমে। ৫০ বছরের বেশি সময় ধরে চলে এই গবেষণা। এরপর বিজ্ঞানীরা সাধারণ ও নিরাপদ রেফ্রিজারেটর তৈরিতে সক্ষম হন। জীবনযাত্রার ধরন বদলের সঙ্গে সঙ্গে রেফ্রিজারেটর যেন এখন ঘরের অন্যতম আসবাব।

অতীত ঘেঁটে
প্রাচীনকাল থেকেই মানুষ সব সময় খুঁজেছে ঠাণ্ডা করার উপায়। প্রাচীন মিসরে পানীয় ঠাণ্ডা করার জন্য বোতল মাটির পাত্রে থাকা পানিতে ডুবিয়ে রেখে আরেকটি মাটির পাত্র দিয়ে ঢেকে দেওয়া হতো। আর আধুনিক সময়ে রেফ্রিজারেটর নির্মাণের চেষ্টা শুরু হয় ১৯০০ সালের দিকে। ওই সমযকার ঠাণ্ডার প্রয়োজন ও চিত্রটা ছিল আরেক রকম!  ইউরোপে তখন ঠাণ্ডার প্রয়োজন মেটাতে বাড়ি বাড়ি যেত আইসম্যান। এখন যেমন সকালে হকার পত্রিকা দিতে আসে। আইসম্যান আসতেন বিশাল বিশাল বরফখণ্ড নিয়ে। সেখান থেকে খণ্ড কিনে নিয়ে রেখে দেওয়া হতো বাসায় থাকা একটি কাঠের বক্সে। সেই বক্সের নিচে থাকত আরেকটি বক্স। নিচের বক্সে থাকত পানীয়র বোতলগুলো। সাধারণত প্রতি দুদিন পর পর আইসম্যান বরফ দিয়ে যেত। উনবিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে রেফ্রিজারেটর মোটামুটি এমনই ছিল। এই পদ্ধতি চলে বেশ কিছুদিন। পদ্ধতিটি জনপ্রিয়তা পাওয়ায় লেকের ওপর জমা বরফ কেটে বিক্রি করার ইন্ডাস্ট্রিও গড়ে ওঠে সে সময়। তখনো কৃত্রিম উপায়ে পানি বরফ করার পদ্ধতি কেউ আপন করে নেয়নি।
এভাবেই চলতে পারত! তবে সমস্যা হয় অস্ট্রেলিয়ার মানুষের জন্য। তাপমাত্রা বেশি হওয়ার কারণে সেখানে প্রাকৃতিক বরফ পাওয়া যেত না। বিদেশ থেকে বরফ আমদানি করাও কঠিন। তাই তারা বৈজ্ঞানিক সমাধান খুঁজতে থাকল। প্রথম সমাধান দেন জ্যাকব পার্কিনস। তবে সমাধানটিকে দেখা হলো বাঁকা চোখে। কারণ বৈজ্ঞানিক উপায়ে গেলে বরফ কাটার শিল্প নষ্ট হবে এবং বেকার হয়ে পড়বে এই শিল্পে জড়িত থাকা হাজার হাজার মানুষ। তবে জেমস হ্যারিস নামক একজন অস্ট্রেলীয় সাংবাদিক পারকিনসের প্রযুক্তিতে আগ্রহ দেখাল এবং কৃত্রিম উপায়ে বরফ বানানোর মেশিন তৈরি করে সেটি নিয়ে গেল অস্ট্রেলিয়ায়। আর এভাবেই শুরু হলো অধুনিক রেফ্রিজারেটরের যাত্রা।

প্রযুক্তিটা কী
কোনো বস্তুর চারপাশে অবিরত ঠাণ্ডা বাতাস দেওয়া গেলে সেটি শীতল হয়ে পড়বে। এই ধারণা সামনে রেখেই তৈরি হয় রেফ্রিজারেটর। প্রশ্ন আসতে পারে কেন ঠাণ্ডা হবে? উত্তর—এটাই প্রকৃতির নিয়ম। নিম্ন তাপমাত্রার কোনো বস্তু উচ্চ তাপমাত্রার বস্তু থেকে তাপ শুষে নেবেই। এ কাজটিই কতটা সহজে ও কম খরচে করা যায় সেটিই ছিল প্রধান চ্যালেঞ্জ। ১৯২৭ সালে প্রথম আধুনিক ব্যক্তিগত রেফ্রিজারেটর বাজারে আনে মার্কিন প্রতিষ্ঠান জেনারেল ইলেকট্রিক। তখন কম্প্রেসর ও কয়েলের অবস্থান ছিল রেফ্রিজারেটরের উপরি ভাগে।
পুরো পদ্ধতিটি হচ্ছে—একটি গ্যাসকে চাপে ও তাপে তরল থেকে বায়বীয়, ঠাণ্ডা থেকে গরম করার খেলা। এই গ্যাসকে বলা হয় রেফ্রিজারেন্ট। যা স্বাভাবিক তাপমাত্রায় বায়বীয় পদার্থ। এটিকে প্রবল চাপে তরল করে রাখা হয়। কোনো বায়বীয় পদার্থকে চাপ প্রয়োগে তরল করা হলে সেটির তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায়। একইভাবে চাপ কমালে তাপমাত্রাও কমে যায়। আধুনিক রেফ্রিজারেটরগুলোতে টেট্রাফ্লুরোইথেন নামে একটি গ্যাস ব্যবহার করা হয়, যা দুই ধরনের কয়েলের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়। খেয়াল করলে দেখতে পাবেন রেফ্রিজারেটরের পেছনের দিকে একটি কয়েল দেখা যায়। যাকে বলা হয় কনডেনসার কয়েল। আর ফ্রিজের প্রতিটি তাকের ভেতরে একধরনের কয়েল থাকে। এগুলোকে ইভেপারেটর কয়েল বলে। দুটি কয়েলের কাজ দুই রকম। ইভেপারেটর কয়েল ভেতরের গরম খাবার থেকে তাপ গ্রহণ করে আর কনডেনসার কয়েল সেই তাপ বাইরে ছেড়ে দেয়। রেফ্রিজারেন্ট পদার্থটি শুরুতে প্রবল চাপে তরল থাকে। রেফ্রিজারেটরের ভেতরের প্রবেশের আগে সেই পদার্থের চাপকে ছেড়ে দেওয়া হয়। ফলে সেটি তরল থেকে গ্যাসে পরিণত হয় এবং তাপমাত্রা অনেক কমে যায়। ফলে ফ্রিজের ভেতরে গরম কিছু থাকলে সেটির তাপ বায়বীয় রেফ্রিজারেন্ট শুষে নিয়ে খাবারকে ঠাণ্ডা করে; তবে নিজে গরম হয়। এ জন্য চালু থাকা অবস্থায় রেফ্রিজারেটরের পাশে হাত দিলে কিছুটা উষ্ণতা অনুভূত হয়। এরপর উষ্ণ গ্যাস কমেপ্রসরে আসে এবং সেখানে সেই গ্যাসকে চাপ প্রয়োগ করে বাইরের কনডেনসার কয়েলে পাঠানো হলে সেটি মুক্ত বাতাসে তাপ ছেড়ে আবার তরল অবস্থায় ফিরে যায়। একইভাবে আবারও রেফ্রিজারেটরে প্রবেশ করে। এই প্রক্রিয়া চক্রাকারে চলতেই থাকে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, তাহলে বাড়িতে থাকা রেফ্রিজারেটরের দুটি অংশে আলাদা আলাদা তাপ কেন? এর কারণ হচ্ছে একটি অংশকে আমরা বলি ডিপ ফ্রিজ, আরেকটিকে বলি নরমাল ফ্রিজ। মূলত ডিপ ফ্রিজের নাম ফ্রিজার ও নরমাল ফ্রিজের নাম হচ্ছে রেফ্রিজারেটর।

স্মার্ট হচ্ছে রেফ্রিজারেটর
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে যেমন অন্যান্য যন্ত্রও স্মার্ট হচ্ছে সেই সঙ্গে স্মার্ট হচ্ছে রেফ্রিজারেটরও। রেফ্রিজারেটরও যুক্ত হয়ে যাচ্ছে আপনার স্মার্টফোনের সঙ্গে। অর্থাৎ স্মার্টফোন থেকেই আপনি নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন ফ্রিজের তাপমাত্রা। স্মার্টফ্রিজে আছে প্রতিটি ধাপে আলাদা আলাদা তাপমাত্রা ব্যবহার করার সুবিধা।  সেই সঙ্গে এলইডি লাইটিং ও ডিজিটাল তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি তো থাকছেই।

আছে অসুবিধাও
রেফ্রিজারেটর তৈরির লক্ষ্যই মানুষের দৈনন্দিন জীবনকে আরো সহজ করার জন্য। যেমন পানিকে বরফ করা, খাবার তাজা রাখা। তাই রেফ্রিজারেটরের সুবিধার কথা বলাই বাহুল্য। তবে অসুবিধার দিক যে নেই তা নয়। যেমন—আমরা রান্না করা খাবার রেফ্রিজারেটরে অনেক দিন ধরে রেখে খেতে পছন্দ করি। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, রান্না করা খাবার তিন দিনের বেশি রেফ্রিজারেটরে রাখা উচিত নয়। মেরেকেটে এক সপ্তাহ পর্যন্ত রাখা যেতে পারে। তাও নির্ভর করে খাবারের ধরনের ওপর। যেসব রান্না করা খাবারে পানি বেশি থাকে সেগুলোতে ব্যাকটেরিয়া জন্মাতে পারে। এই ফ্রিজে রান্না করা খাবার রাখার সময় বাটিটি টিস্যু দিয়ে মুছে নিলে সেখানে পানি থাকবে না। অতিরিক্ত গরমের দিনে ঘন ঘন ফ্রিজ খোলা থেকে বিরত থাকবেন। তবে শুকনো খাবার রেফ্রিজারেটরেই ভালো থাকতে পারে অনেক দিন।

1 comment: